জিয়াউর রহমান
(১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারী - ১৯৮১ সালের ৩০ মে)

জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারী বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম ছিল মনসুর রহমান এবং মাতার নাম ছিল জাহানারা খাতুন ওরফে রানী।পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়।
তাঁর পিতা কলকাতা শহরে সরকারী দপ্তরে উচ্চ পদস্থ রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।তাঁর শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা শহরে অতিবাহিত হয়।
ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর তাঁর পিতা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে চলে যান।তখন জিয়া কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং তারপর ১৯৫৩ সালে করাচির ডি.জে কলেজে ভর্ত্তি হন।একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন।সামরিক বাহিনীতে তিনি একজন সুদক্ষ প্যারাট্রুপার ও কমান্ডো হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন এবং স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।করাচীতে দুই বছর চাকরী করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলী হয়ে আসেন।
তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন।ঐ সময়ই ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরের মেয়ে খালেদা খানমের সঙ্গে জিয়াউর রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানীর কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন।

যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতার প্রদর্শনের জন্য যেসব কোম্পানী সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে, জিয়াউর রহমানের কোম্পানী ছিল এদের অন্যতম।এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভ‚ষিত করে।এছাড়াও জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টি তামঘা-ই-জুরাত মেডাল লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন কমান্ড পদে দায়িত্ব লাভ করেন।এডভান্সড মিলিটারি এন্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান এবং কয়েক মাস বৃটিশ আর্মির সাথেও কাজ করেন। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্রগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন কমান্ড পদের দায়িত্ব দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙ্গালীর ওপর বর্বরের মতো ঘৃন্য হামলা চালায়। সে রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রহস্যজনক ভাবে বন্দী হন।সকল আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে।জনগণ তখন কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সঙ্কটময় মূহুর্তে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতেই গর্জে উঠলেন জিয়াউর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রতি হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, উই রিভোল্ড। অর্থাৎ এই মূহুর্তে থেকে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য লড়াই করবো। অত:পর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে তিনি ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষনা দিলেন। তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সেই অমোঘ বানী– “ I Major Ziaur Rahman, Provisional President and Commander – in Chief of Liberation Army, do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle.Bangladesh is independent. We have waged war for the liberation of Bangladesh. Everybodys is requested to participate in the liberation war with whatever we have. We will have to fight and liberate the country from the occupation of pakistan Army. Inshallah victory is ours’’
মেজর জিয়া এবং তাঁর বাহিনী সামনের সারি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বেশ কয়েকদিন তাঁরা চট্রগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে সক্ষম হন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে প্রথমে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং চট্রগ্রাম,পার্বত্য চট্রগ্রাম,নোয়াখালী,রাঙ্গামাটি,মিরেরসরাই,রামগড়,ফেনী প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। তিনি সেনা-ছাত্র-যুব সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে ১ম,৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই তিনটি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স-এর অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত ১১ নং সেক্টরের ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয়। স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানেকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ-অফ-স্টাফ নিযুক্ত হন।১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে, ঐ বছরেই শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন।১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহন করেন।৭ ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবে জিয়াউর রহমান আবারও দেশ রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ ও কর্নেল সাফায়াত জামিল এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুথান ঘটান। এর ফলে ৬ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন।এরপর জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাঁকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয় যা সেনাবাহিনীর মধ্যে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ ও কর্নেল সাফায়াত জামিল গংদের সাথে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ক্ষমতা দখলের পাল্টাপাল্টি অশুভ তৎপরতায় যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্নের মুখে ঠিক তখনই সেনাবাহিনীর সর্বস্তরের সৈনিক ও অফিসাররা অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে আসেন। প্রথমেই ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সেনা সদস্যরা লেঃ কর্ণেল মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানকে তার তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে মিছিল সহকারে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে আসেন। ঐ দিনই কর্ণেল আবু তাহেরর অধীনস্থ সৈন্যরা ক্যাপ্টেন জলিল ও ক্যাপ্টেন আসাদের নেতৃত্বে শেরে বাঙ্গলা নগরে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আশ্রায় নেয়া ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ,কর্নেল সাফায়াত জামিল, কর্ণেল খন্দকার নাজমুল হুদা, লেঃ কর্নেল এটিএম হায়দার কে হত্যা করে।এরপর নৈরাজ্যের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য সিপাহী-জনতার প্রবল দাবীর মুখে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসেন। ১৯ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ-অফ-স্টাফ পদে দায়িত্ব প্রত্যাবর্তন করা হয় রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েম তাকে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব প্রদান করেন।জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন।১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ সাত জাতি গ্রুপ চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন কর্মসূচী উদ্বোধন করেন।১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তাঁকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়।১৯৭৭ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি একুশের পদক প্রবর্তন করেন।রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েম শারীরিক অসুস্থ্যতাজনিত কারনে পদত্যাগ করলে জিয়াউর রহমান ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রবর্তিত বাকশাল বিল্প্তু করে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন। ১৯৭৮ সালে ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন।এ নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্ধী ছিল।এরপর জিয়াউর রহমান ৩০ এপ্রিল ১৯ দফা কর্মসূচী ঘোষনা করেন এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০ শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ-সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন।জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ত্তত্ব প্রদান করলে বাংলাদেশের সকল নাগরিক তা গ্রহন করেন।বাংলাদেশে বহু সংখ্যাক বিভিন্ন ধরনের মতের ও ধর্মের নানা জাতিগোষ্ঠী বাস করে।তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরন একে অপরের থেকে ভিন্ন।তাই জিয়াউর রহমান ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয় বরং ভ‚খন্ডের বৈশিষ্ট্যেও ভিত্তিতেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান দেশে শান্তি,শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন।
তিনি দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের প্রতিটিকে এক একটি স্ব-নির্ভর ইউনিট হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান স্বনির্ভর আন্দোলনের সাথে কৃষি, সেচ, বৃক্ষরোপন, গৃহ-নির্মাণ, বিদ্যুতায়ন, স্বাস্থ্যরক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা এবং আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। খাদ্যে স্বাবলম্বী হবার বিষয়টিকে জিয়াউর রহমান তাঁর জাতীয় নীতি হিসেবে ঘোষনা করেছিলেন। খাদ্য উৎপাদন দ্বি-গুণ করাকে স্বনির্ভরতা আন্দোলনের সোপান হিসেবে মনে করতেন জিয়াউর রহমান। এ লক্ষ্যে তিনি খাল খনন করে শুষ্ক মৌসুমে সেচ ব্যবস্থা সচল করা, একই জমিতে একাধিক ফসল ফলানো, পতিত জমিতে চাষাবাদে গুরুত্বারোপ করাকে তার উন্নয়নের অগ্রাধিকার কর্মসূচি হিসেবে দেশব্যাপি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। খড়া মৌসুমে চাষাবাদে নিরবিচ্ছিন্ন সেচ নিশ্চিত করনে তাঁর আমলে প্রায় ৯০০ মাইল দীর্ঘ খাল খনন করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমার দেশকে স্বনির্ভরতার লক্ষ্য অর্জনের পরিপূরক হিসেবে গণস্বাক্ষরতা কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। গণস্বাক্ষরতা কর্মসুচিকে মুলধারার শিক্ষার সাথে সংযুক্ত করে দেশের স্বাক্ষরতার হারকে বৃদ্ধি করেছিলেন। মূলত মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারন করে তিনি ১৯৮০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বহুল প্রশংসিত গণস্বাক্ষরতা কর্মসূচি ঘোষনা করেছিলেন। গণনন্দিত এই কর্মসূচির মাধ্যমে খুব স্বল্প সময়ে দেশে প্রায় ৪০ লক্ষ নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান করতে পেরেছিলেন। মূলত ১৯৮৫ সালের মধ্যে দেশের স্বাক্ষরতার হার ৮০% উন্নীতকরণের লক্ষমাত্রা নিয়ে জিয়াউর রহমান স্বাক্ষরতা কর্মসূচি ঘোষনা করেছিলেন।
জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে দেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে ‘এক ছেলে এক মেয়ে’ ধারণাকে নীতি ও আদর্শ হিসেবে প্রচার করেন এবং তা বাস্তবায়নে ১৯৭৬ সালে গ্রাম ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ৩৮ হাজার পরিবার পরিকল্পনা কর্মী নিয়োগ করেন। ক্ষমতাকে গ্রাম পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকরণ করার জন্য এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষে ১৯৮০ সালের ৩০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রচলণ করেন। ১৯৮০ সালের ২১ জুন জিয়াউর রহমানের সরকার মহান জাতীয় সংসদে গ্রাম সরকার বিল উত্থাপন করেন এবং তা একই দিনে অনুমোদিত হয়। এর ফলে ছোট ছোট সমস্যা গ্রামেই সমাধান হতে থাকে। মামলা মোকদ্দমা উল্লেখযোগ্যহারে কমে আসে। ১৯৭৮ সালের এক জরিপে জানা যায় যে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশই যুবক। হতাশা, সন্ত্রাস ও বেকারত্ব ও মাদকাসক্ত থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করে তাদেরকে উন্নয়নের মুলধারায় ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শেরে বাংলা নগরে দুদিন ব্যাপী জাতীয় যুব সস্মেলন আয়োজন করে যুব সমাজকে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
যুব সমাজকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানোর জন্য ১৯৭৮ সালে তিনি দেশে প্রথমবারের মত যুব মন্ত্রনালয় চালু করেন। জেলায় জেলায় যুব কমপ্লেক্স চালু করে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তাদের স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সাহায়্য করেন। গ্রামীণ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেশীয় উন্নয়ণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার হওয়া সত্বেও স্বাধীন দেশে তা ছিলো অনেকটায় অবহেলিত ও উপেক্ষিত। গ্রামের মানুষের অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শহীদ জিয়া ১৯৭৬ সালে ভিডিপি বা গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠন করেন। সেদিনের সেই বাহিনী আজ গ্রামীন জনগোষ্ঠীর শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। আজকের শিশু আগামীর রাষ্ট্রনায়ক। তাই শহীদ জিয়া শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য ১৯৭৭ সালের ১৫ জুলাই শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিশুদের মেধাবিকাশে টিভিতে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা চালু করে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন।প্রেসিডেন্ট জিয়া বহি:বিশ্বে দেশের অপ্রচলিত গার্মেন্টস শিল্প, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্প, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করেছিলেন। জিয়ার হাতধরেই গড়ে উঠা সেদিনের শিশু গার্মেন্ট শিল্প আজ দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই বিপুল সংখ্যক নারীকে কর্মহীন রেখে কোনভাবেই যে সদ্য স্বাধীন একটি জনবহুল দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় সেটা উপলব্ধি করে শহীদ জিয়া নারীদেরকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করে দেশের সার্বিক উন্নয়নের চাকাকে গতিশীল করার জন্য মহিলা বিষয়ক মন্ত্রনালয় প্রতিষ্ঠা করে নারীদের ক্ষমতায়ন ও সমাজে তাদের যথাযথ সস্মান নিশ্চিত করেছিলেন। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচার ও প্রসার এবং বিজ্ঞানমনস্ক জাতী গঠনে তিনিই প্রথম দেশে পৃথক একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদরাসা তথা ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে নৈতিকতা সম্পূর্ণ সুনাগরিক গড়ে তোলার জন্য স্বাধীনদেশে সর্বপ্রথম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা আবার স্বাধীন দেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
শহীদ রাষ্টপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করে সহজেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় এসেই ইন্দে-সোভিয়েত বলয় থেকে বের হয়ে আমেরিকা ও চীনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। তিনি তার সাহসী, চৌকস ও দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির কারণে মুসলিম বিশ্বের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তাঁর স্বল্প সময়ের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে ইরাক-ইরান যুদ্ধে একক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভুমিকা পালন, আল কুদস কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া, ফিলিস্তিন জনগণের প্রতি অবিচল সমর্থন, ওআইসিকে একটি কার্যকরি সংগঠনে পরিনত করার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার ভুমিকা মুসলিম বিশ্ব আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তিনিই মুলত মুসলিম বিশ্বে শ্রমবাজার সৃষ্টি করে সরকারিভাবে কর্মী প্রেরণ করেন। শহীদ জিয়া দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভু-রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টির জন্য সার্ক প্রতিষ্টার উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন। তাই তাঁকে সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়ে থাকে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্রগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে তিনি নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ চোখের জল ফেলে। তিনি এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে,মৃত্যুর পর বাংলাদেশের দূর-দূরান্ত থেকে লাখ লাখ জনতা ঢাকায় তাঁর জানাজা নামাজে অংশগ্রহন করে। সম্ভবত এটি বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বড় জানাজা নামাজ ছিল। জিয়া আজ নেই কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা সহ দেশের মানুষের সকল মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আাদয়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।