মুক্তিযুদ্ধ এবং জিয়াউর রহমান
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারগণ, যুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের নেতৃবৃন্দ,রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদদের লিখনীতে স্বাধীনতার ঘোষনার প্রমান
১. জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং যুদ্ধ সম্পর্কে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বেতার ভাষণে পরিষ্কার করে দিয়ে গেছেন।১১ এপ্রিল ১৯৭১ এক বেতার ভাষনে তিনি বলেন, ‘‘first announced through Major Zia Rahman, to set up a fullfledged operational base from which it is administering the liberated areas”(Bangladesh Document vol-I, Indian Government, page-284)
২.মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার (১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১), আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) তার- ‘A Tale of Million’ বইয়ের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,“২৭ মার্চ বিকালে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন।”
৩. মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকার ‘মুক্তি যুদ্ধের পুর্বাপর’ বইতে লিখেছেন, ‘‘মেজর জিয়া কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষনাটি দিলেন, সে ঘোষনায় তিনি নিজেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষনা করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, জিয়ার ২৭ মার্চের ঘোষনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যারা দেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা ছিলেন,তাদের মধ্যে যে একটা প্রচন্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। যে সম্পর্কে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।’’
৪. মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার পরবর্তীতে সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম) তাঁর [Bangladesh at War, Academic Publishers, Dhaka 1989] বইয়ের ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘‘মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মোকাবেলার জন্য সবাইকে আহবান জানান। এতে তিনি নিজেকে রাষ্ট্র প্রধান রূপে ঘোষণা করেন।
৫.মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী (বীর উত্তম), (পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল) লিখেছেন, ‘‘অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এবং পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিলে আমি সানন্দে যুদ্ধে যোগদান করি।’’ এছাড়াও ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ মীর শওকত আলী (বীর উত্তম)-এর একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় বাংলাভিশন চ্যানেলে। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মেজর জিয়া রিভোল্ট করেন এবং পরে নিজের নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’’
৬.বর্তমান আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মেজর এম এস এ ভূঁইয়া (সুবিদ আলী ভূঁইয়া) তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘‘এখানে মেজর জিয়াউর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, বেতার কেন্দ্র থেকে যাঁরা সেদিন মেজর জিয়ার ভাষণ শুনেছিলেন তাঁদের নিশ্চয় মনে আছে, মেজর জিয়া তাঁর প্রথম দিনের ভাষণে নিজেকে ‘হেড অব দি স্টেট’ অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রধান রূপেই ঘোষণা করেছিলেন।’’
৭. বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান রচিত ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধঃ একজন সেক্টর কমান্ডারের স্মৃতিকথা’ বইতে তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘‘মেজর জিয়া নিজেকে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।’’
৮. জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক মরহুম হুমায়ুন আহমদ তার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে উল্লেখ করেন -‘‘একাত্তরের ২৭ মার্চ শনিবার রাত আটটায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভূত একটা ঘোষণা শুনতে পায়… মেজর জিয়া নামের একজন নিজেকে রাষ্ট্র প্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন। দেশের মানুষের ভেতর দিয়ে তীব্র ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়… তাদের নেতিয়ে পড়া মেরুদন্ড একটি ঘোষণায় ঋজু হয়ে যায়…তাদের চোখ ঝলমল করতে থাকে। একজন অচেনা অজানা লোকের কণ্ঠস্বর এতোটা উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে ভাবাই যায় না।’’
৯. জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের রাজনৈতিক সচিব মঈদুল হাসান বলেন, “অন্যের কথা কী বলব, মেজর জিয়ার বেতার ঘোষণা শুনে আমি নিজে মনে করেছিলাম যে- না, সত্যি তাহলে সামরিক বাহিনীর বিপুল সংখ্যক লোক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। এটা আমার মনে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং আমি উৎসাহিত বোধ করি। আমি আশপাশে যাদের চিনতাম, তারাও এই ঘোষণায় উৎসাহিত হন।
১০. বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-১৯৭৫’ বইতে স্বাধীনতা ঘোষনা সম্পর্কে লিখেন, ‘‘আমি জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সহিত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করিতাম এবং মাঝে মাঝে অভয়দাস লেনের বাসায় রাত্রি যাপন করিতাম। তাহার বাসায় রাত্রি যাপন করিতে গিয়া তাহারই রেডিও সেটে ২৭শে মার্চ চট্রগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলার রেডিওর এই ঘোষনা শুনতে পাই। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হয়েছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিশেহারা, হতভম্ব,সম্ভিত হারা ও মুক্তিপ্রাণ বাঙ্গালী জনতা শুনিতে পায় এক অভয় বাণী,আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়িবার আহবান,স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ।’’
১১. শেখ মুজিবের ৪র্থ পুত্রের দাবীদার বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ২০১১ সালের ২ এপ্রিল জানান দেন, “আমি চট্টগ্রাম থেকে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শুনেছি এবং উৎসাহিত হয়েছি। আজ যারা এ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করছেন তারাও শুনেছেন এবং উৎসাহিত হয়েছেন।
১২. ১৯৭২ সালের ২১শে ফেবরুয়ারী উদযাপন উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমীতে মুক্তিযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডার বক্ততা দিয়েছিলেন। সেক্টর কমান্ডারদের উপস্থিতিতে যখন জিয়াউর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়, “২৫ মার্চ পাক বাহিনীর বর্বর হামলার পর চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনাকারী ও তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলার কৃতিত্বের অধিকারী কর্নেল জিয়াউর রহমান” তুমুল করতালির মধ্যে বক্তব্য করতে ওঠেন (সূত্র: দৈনিক বাংলা ২০/২/১৯৭২)
১৩. দেশ স্বাধীনের পরেও ১৯৭২ সালের ৮ই এপ্রিল আওয়ামীলীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারন সম্পাদকের রিপোর্টে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে তাজউদ্দিন বলেন, “আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে চট্টগ্রামে সংগ্রামরত মেজর জিয়াউর রহমান বেতার মারফত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা প্রচার করেন এবং বাংলাদেশে গণহত্যা রোধ করতে সারা পৃথিবীর সাহায্য কামনা করেন” (সূত্রঃ দৈনিক বাংলা, ৯ এপ্রিল- ১৯৭২)।
১৪. প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের সম্পাদনায় বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ২০০৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার ৪৯ নম্বর পাতায় মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে লেখা হয়, ‘‘একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনারা বাঙালী হত্যার অভিযানে লিপ্ত হবার পর তাদের হাতে বন্দী হন শেখ মুজিবুর রহমান।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সংকটময় মুহূর্তে একাত্তরের ২৬ ও ২৭ মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বাংলাদেশের পূর্ব বিঘোষিত পতাকা সমুন্নত রাখে। মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মেজর জিয়া এবং তার বাহিনী সামনের সারিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।’’
১৫. বর্তমান সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী, সাবেক আমলা আবুল মাল আবদুল মুহিত তার বইয়ে উল্লেখ করেন, “The next evening Major Zia announced the formatica of a provisional government under his and solicited the support of the world in the liberation of Bangladesh”
১৬. বুদ্ধিজীবী ও লেখক বদরুদ্দিন উমর লিখেছেন, ‘‘মেজর জিয়াই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন আর সেটা সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রতিরোধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। সেটা ঘটেছিল এমন এক মুহূর্তে যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব অকেজো হয়ে পড়েছিল।’’